জো বাইডেনের শপথের আগেই কাতার অবরোধ প্রত্যাহার সৌদির
তৃতীয় মাত্রা
২০১৭ সালের জুনে একেবারে বিনামেঘে বজ্রপাতের মতো অবরোধের সংবাদ কাতারের নাগরিকদেরকে বিমূঢ় করে দেয়। মাত্র কয়েক দিন আগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প রিয়াদ সফর করেছেন। সেখানে মধ্যপ্রাচ্যের মার্কিন মিত্রদের মাঝে কাতারের আমিরও উপস্থিত ছিলেন।
সাথে সাথে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের টুইট ভেসে আসে: দেখো আমার হেডাম।
কিছুটা হতচকিয়ে গেলাম; মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার সবচেয়ে বড় বিঘানঘাঁটি কাতারে, সেই আমেরিকার উসকানিতে কিনা কাতার অবরুদ্ধ হল!
অচিরেই গলার ফাঁস আলগা করতে সক্ষম হল কাতার।
কাতারের ভাগ্যই বলতে হবে, ইরান ও তুরস্কের মত দুটি শক্তিশালী রাষ্ট্র তার সাহায্যে এগিয়ে এল পণ্য ও সৈন্য নিয়ে। তুরস্কের পার্লামেন্টে এতো দ্রুত কাতারে সৈন্য মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, সৌদির যদি আক্রমণের ইচ্ছাও থাকত তবুও তারা সে সময় পেত না।
এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, কাতারের সক্ষমতা মূল্যায়নে আমিরাত ও সৌদি আরব দু-দেশই চরম ভুল করেছে। যুক্তরাষ্ট্রে কাতারের প্রধান তদবিকারী হল পেন্টাগন (রূপকার্থে)।
মধ্যপ্রাচ্যের যে দেশে পেন্টাগনের সবচেয়ে বড় ঘাঁটি আছে; সে দেশের নিরাপত্তার কথা তারা চিন্তা না করে পারে না। তাছাড়া সৌদির মত সফট পাওয়ারেরও কোন ঘাটতি ছিল না কাতারের।
কাতার এতটা স্মার্টলি অবরোধ ঠেকাতে পেরেছে যে, প্রথমদিকে অবরোধ তুলে নিতে কিছু অনুরোধমূলক বক্তব্য রাখলেও শেষের দিকে কাতার নির্বিকার হয়ে যায়।
কুয়েতের লোকান্তরিত আমীরের ওপর আল্লাহর রহমত নাযিল হোক। ইরাকের দখল হতে মুক্তি পাওয়ার পর থেকে তিনি নিরপেক্ষতার সোজা দণ্ডের ওপর দিয়ে চলাচল করেন। একেবারে প্রথম দিন থেকে তিনি দূতিয়ালির চেষ্টা করেছেন।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট না হলে এত তাড়াতাড়ি নিষ্ফল অবরোধের সমাপ্তি ঘটত না। বাইডেন সৌদি যুবরাজের ব্যাপারে কড়া মনোভাব প্রকাশ করেছিলেন।
শুধু বাইডেন নয়; সৌদির জন্য একটি অশনিসংকেত হলো যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রায় পৌনে শতাব্দীর সম্পর্ক রাষ্ট্রের পরিবর্তে দলীয় সম্পর্কে পর্যবসিত হয়ে গেছে। ডেমোক্র্যাটিক দলে সৌদিবিরোধী এত বেশি কংগ্রেসম্যান আছে যে, নতুন প্রশাসনের সাথে কাজ করতে সৌদির বেগ পেতে হবে।
ইতোপূর্বে ডেমোক্র্যাট-রিপাবলিকান নির্বিশেষে সব দলের সরকারের সাথে সৌদির ভাল সম্পর্ক ছিল। কিন্তু সৌদির সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের প্রথম শৈথিল্য দেখা যায় ওবামা প্রশাসনের সময়, যখন সৌদি জোরালো আপত্তি উপেক্ষা করে ইরানের সাথে পরমাণু চুক্তি করে যুক্তরাষ্ট্র।
সৌদির ভাগ্যই বলতে হবে, অব্যবহিত পরে যুক্তরাষ্ট্রে এমন একজন প্রেসিডেন্ট আসল যে কিনা সৌদি যুবরাজকে ব্লাংক চেক দিয়ে বসেছে। অবশ্য পেছনে কলকাঠি নেড়েছেন ট্রাম্প-জামাতা জারেড কুশনার, যিনি কার্যত সৌদি শাসক এমবিএসের ঘনিষ্ট বন্ধু।
সেই কুশনার আবারো যুবরাজের সাহায্যে এগিয়ে এলেন। উপসাগর-সঙ্কট অবসানে কুয়েতের আমিরের পর সবাই তার অবদান স্বীকার করেছে।
সৌদি আরব বাইডেনের অস্বস্তির বিষয়গুলো দূর করতে চাইছে। কাতার অবরোধের তেরো দফার একটি দফাও বাস্তবায়িত হয়নি; তবুও কাতার-অবরোধ তুলে নেয়া হয়েছে।
নেপথ্যের চাপ হল যুক্তরাষ্ট্রে কম বন্ধুভাবাপন্ন প্রেসিডেন্ট। কয়েকদিন আগে ইয়েমেনের ব্যাপারেও সৌদি আরব কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। সেখানে দক্ষিণের ১২ ও উত্তরের ১২ জন মন্ত্রী নিয়ে নতুন সরকার গঠিত হয়েছে।
সৌদি দেখাতে চাইবে, এই সরকারের প্রতি ইয়েমেনের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগনের সমর্থন রয়েছে। এভাবে আঞ্চলিক ঝামেলা কমিয়ে বাইডেনের মুখোমুখি হওয়া এমবিএসের জন্য কিছুটা সহজতর।
সৌদির কিছু অদৃশ্য শক্তি আছে, সফট পাওয়ার আছে; যা ব্যবহার করে দেশটি সবসময় সঙ্কট এড়িয়েছে। এবারো নিশ্চয়ই তা প্রয়োগ করবে।
তবুও দেশটিকে এবার অতিরিক্ত সতর্ক দেখা যাচ্ছে, তাই সৌদি আরবকে এমন কিছু পদক্ষেপ নিতে দেখা যাচ্ছে, অন্য সময় হলে সে হয়ত তা বিবেচনাই করত না। দেখা যাক, নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্টের আমলে সৌদি আরব আবারো দ-দেশের সম্পর্ক দলীয় গণ্ডির বাইরে নিয়ে যেতে পারে কিনা। সূত্র: যুগান্তর
লেখক: ড. যুবাইর মুহাম্মদ এহসানুল হক, অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়