
চুয়াডাঙ্গায় যথাযোগ্য মর্যাদায় মুক্ত দিবস পালিত
চুয়াডাঙ্গা প্রতিনিধিঃ
আজ ৭ ডিসেম্বর চুয়াডাঙ্গা মুক্ত দিবস। যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হচ্ছে দিবসটি। মুক্তিযুদ্ধে জীবন উৎসর্গকারী শহিদদের স্মরণে বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হচ্ছে।
বুধবার সকাল ৭টায় দিবসটি উপলক্ষে শহরের শহিদ হাসান চত্বরের স্মৃতিস্তম্ভে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়। প্রথমে চুয়াডাঙ্গা-১ আসনের সংসদ সদস্য সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করেন।
পরে জেলা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিট, জেলা প্রশাসন, পুলিশ বিভাগসহ বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান-সংগঠনের পক্ষ থেকে ফুলেল শ্রদ্ধা জানানো হয়। এছাড়া দিবসটি উপলক্ষে জেলা প্রশাসনের আয়োজনে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।
১৯৭১ সালের এইদিনে পাক হানাদার বাহিনীকে হটিয়ে চুয়াডাঙ্গা জেলাকে শত্রুমুক্ত করেন বাংলার দামাল ছেলেরা। সেদিন থেকেই চুয়াডাঙ্গার আকাশে ওড়ে বিজয়ের কেতন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন চুয়াডাঙ্গা ছিল দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনের প্রধান কার্যালয়। স্বাধীনতা যুদ্ধের সূতিকাগার বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাজধানীও ছিল চুয়াডাঙ্গা।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালোরাতে হানাদার বাহিনীর নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞের পরই চুয়াডাঙ্গার হাজার হাজার মুক্তিপাগল দামাল ছেলে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলেন। একই রাতে যশোর সেনানিবাস হতে এক দল সৈন্য কুষ্টিয়া শহর দখল করে নেয়ার খবরে মুক্তিযোদ্ধারা শহর রক্ষার জন্য শহরের প্রবেশ পথগুলোতে গাছের ডাল ফেলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন। একইসঙ্গে চুয়াডাঙ্গার বিভিন্ন এলাকা থেকে আনসার, মুজাহিদ ও স্বেচ্ছাসেবকদের শহরের টাউন হলে একত্রিত করে চুয়াডাঙ্গা ট্রেজারি থেকে সব অস্ত্র ও গোলাবারুদ তাদের মধ্যে বিলিয়ে দিয়ে প্রতিরোধ ব্যবস্থা মজবুত করে।
এদিকে, চুয়াডাঙ্গা শত্রুমুক্ত থাকার খবর শুনে আওয়ামী লীগের তৎকালীন কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশর অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ ভারত গমনের জন্য সঙ্গী ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলামকে নিয়ে ৩০ মার্চ চুয়াডাঙ্গায় আসেন। এ সময় তিনি স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় সার্বিক পরিস্থিতিতে সন্তোষ প্রকাশ করে চুয়াডাঙ্গাকে যুদ্ধকালীন সময়ের জন্য বাংলাদেশের অস্থায়ী রাজধানী ঘোষণা দেন।
স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরুতেই সীমান্তবর্তী চুয়াডাঙ্গা জেলা মুক্ত ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা শক্তিশালী ছিল। বিদেশি সাংবাদিকদের মাধ্যমে চুয়াডাঙ্গা ডেটলাইনে বাংলাদেশের বাস্তব অবস্থা বিশ্বব্যাপী প্রচারিত হওয়ায় চুয়াডাঙ্গা পাকিস্তানি বাহিনীর টার্গেটে পরিণত হয়।
১০ এপ্রিল ভারতের আগরতলায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে উপস্থিত ২৮ জন সংসদ সদস্যের (এমপি) উপস্থিতিতে এক সভায় অস্থায়ী সরকারের রাজধানী ও শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান বাংলাদেশের চুয়াডাঙ্গায় করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়। যদিও সিদ্ধান্তটি নিরাপত্তাজনিত কারণে গোপন রাখার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু সেই খবরটি দ্রুত বিদেশি বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
এর ফলে পাকিস্তানি বাহিনীর টার্গেটে পরিণত হয় চুয়াডাঙ্গা। এরপরই চুয়াডাঙ্গার ওপর ব্যাপকভাবে বিমান হামলা চালানো শুরু করে হানাদার বাহিনী। একইসঙ্গে যশোর সেনানিবাস থেকে হানাদার বাহিনীর একটি দল ১৬ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গায় প্রবেশ করে। চুয়াডাঙ্গায় প্রবেশের পরই হানাদার বাহিনী নির্বিচারে গুলি চালিয়ে অগণিত মানুষকে হত্যা করে শহর দখলে নেয়। এ খবরে দ্রুত দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনের সদর দফতর চুয়াডাঙ্গা থেকে অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়।
মুক্তিযুদ্ধকালীন যুবনেতা এবং বর্তমানে চুয়াডাঙ্গা-১ আসনের সংসদ সদস্য সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার ছেলুনের নেতৃত্বে চুয়াডাঙ্গার তরুণদের একত্রিত করে ২২ এপ্রিল ভারতের হৃদয়পুর শিবিরে ১২০ জন যুবক নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম ক্যাম্প চালু করা হয়। যুদ্ধ পরিচালনার জন্য ১১ জুলাই বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়।
চুয়াডাঙ্গা ৮ নম্বর সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত হয়। চলতে থাকে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন রণাঙ্গনে সম্মুখ ও গেরিলা যুদ্ধ। ৫ আগস্ট চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার নাটুদহের কাছে বাগোয়ান গ্রামে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে পিন্টু, হাসান, খোকন, কাশেম, রবিউল, রওশন, তারিক ও আফাজউদ্দিন নামে আটজন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহিদ হন। তাদের জগন্নাথপুর গ্রামের দুইটি কবরে দাফন করা হয়, যা এখন আটকবর নামে পরিচিত।
এছাড়া ৭ আগস্ট জীবননগর থানার ধোপাখালি সীমান্তে নিয়মিত বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা ও পাকিস্তানি বাহিনীর মধ্যে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পাঁচজন শহিদ হন। সেপ্টেম্বরে ৮ নম্বর সেক্টর কমান্ডার যুদ্ধ বেগবান করা ও বিজয় অর্জনের লক্ষ্যে যুদ্ধ কৌশলে পরিবর্তন আনেন।
২৬ নভেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীকে হটিয়ে দিয়ে জীবননগরে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। ৪ ডিসেম্বর মুক্ত হয় দর্শনা। এরপর ৭ ডিসেম্বর চুয়াডাঙ্গা ও আলমডাঙ্গা থেকে শত্রুদের হটিয়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন মুক্তিকামী মানুষ। বিজয়ের বেশে চুয়াডাঙ্গায় প্রবেশ করেন মুক্তিযোদ্ধারা।
comment / reply_from
related_post
Popular Posts
newsletter
newsletter_description