
কালের বির্বতণে বিলুপ্তির পথে চুন তৈরি শিল্পো
আঃ মতিন সরকার, সুন্দরগঞ্জ (গাইবান্ধা) প্রতিনিধিঃ
গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলাসহ দেশের গ্রামগঞ্জ বাজার বিভিন্ন স্থানে পান চিবানো খুবই জনপ্রিয় ও পরিচিত। সাধারণত অতিথি আপ্যায়নে বা কোনো বৈঠক আলোচনার শুরুতে পানের ব্যবহার লক্ষ্যণীয়। আর পান বলতে শুধু পান পাতাই বোঝায় না। সঙ্গে থাকে ঠোঁট লাল করার চুন ও সুপারি। ভারতবর্ষ ও বাংলার রসনা বিলাসী মানুষের কাছে পান জনপ্রিয়। পানে স্বাদ জোগাতে চুন আর সুপারি অপরিহার্য। সুপারি গাছে ধরে আমরা সবাই জানি কিন্তু চুন প্রস্তুত করতে হয়। এদেশে চুন বলতে শামুক ও ঝিনুকের তৈরি চুন বোঝাতো।
কিন্তু কালের বিবর্তণে এই জৈব উপায়ে তৈরি চুন এখন বিলুপ্তির পথে। এখন বাজারে দুই ধরনের চুন পেলেও পাথুরে চুনই বেশি। সূত্র মতে, পাথুরে চুন তৈরি হয়, চুনাপাথর ও কেমিক্যাল দিয়ে যা মানুষের শরীরের জন্য খুবই ক্ষতিকর। এই চুন আসলে ঘরবাড়ি চুনকাম করাসহ অন্যান্য কাজে ব্যবহারের জন্য। পাথুরে চুন মানুষের শরীরের ক্যালসিয়াম ও শক্তি ক্ষয় করে এবং দাঁতের ক্ষয়সহ পাকস্থলী নষ্ট করতে ভূমিকা রাখে।পাথুরি চুনে অ্যাসিডের পরিমাণ বেশি থাকায় পাথুরে চুন খাওয়া কখনই উচিত নয়। আর শামুক ও ঝিনুকের চুন মানুষের শরীরের জন্য উপকারী। এই চুন শ্লেষ্মা, অম্ল-পিত্ত-শূল, ব্রণ পাকস্থলী জাতীয় রোগ, মেদোরোগ, ক্রিমি রোগ নষ্ট করে। ঝিনুক চুনের মধ্যে মুক্তার গুণ পাওয়া যায়। আমাদের চামড়ার উপরের অংশ টিস্যুগঠনে যে উজ্জ্বলতা, তা সোনা ও মুক্তার কারণে। তবে চুন তৈরির কাঁচামাল নিত্য প্রজনিত পূর্ণের দাম বাড়ায় চুন তৈরি করে বাজার লোকসানের মুখে পড়ে চুন তৈরির পেশা ছাড়ছেন এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা।
উপজেলার বেলকা ইউনিয়নের জুগিপাড়ায় প্রায় প্রতিটি পরিবারের আয়ের এক মাত্র ছিলো চুন শিল্পো তা কালের বির্বতণে দিন দিন হাড়িয়ে যাচ্ছে। একসময় গ্রামে গেলেই চোখে পড়বে সাদা ধোঁয়ায় হলুদ কিরণ। চোঁখে পরতো ঝিনুক বা শামুক বাড়ীর সামনে এখন আর চোঁখে পড়ে না গ্রামের সেই চিত্র। চুন শিল্পো ছেড়ে বিভিন্ন ব্যবসায় যোগ দিয়েছেন তারা । তবে এখনো কয়েকজন বাপ দাদার শিল্পোকে বেচে রাখতে চারিয়ে আসতেছে এই শিল্পো ।
মীরগঞ্জ হাটের পিস পানে দোকানি ফুল মিয়া জানান, পানের স্বাদ বাড়াতে এতে বিভিন্ন ধরনের উপকরণ মেশানো হয়। যেমন- সুপারি, চুনসহ জর্দা ও বিভিন্ন ধরনের মশলা। চুন ছাড়া পান খাওয়ার কোনো মজাই নেই। তবে এই চুন আজ বিলুপ্তির পথে। এই চুনের কদরও অনেক বেশি থালেও দাম বাড়েনি এখনো। সরেজমিনে গিয়ে কথা হয় আব্দুল হাই জুগির সাথে তিনি জানান, এখানে অর্ধশতাধিক
পরিবার চুন তৈরি ও বিক্রির পেশায় জড়িত ছিলেন। আর সেই চুন থেকে যে আয় হয়, তা দিয়ে কোনো রকম জীবন চলছে তাদের। উপজেলার চুনের একমাত্র তৈরি ও বিক্রির পেশায় সংখ্যাধিক্যের কারণে এলাকার নাম জুগিপাড়া হয়েছে বলে জানান তিনি। তবে ইতোমধ্যে অনেকে ভিন্ন পেশায় যেতে না পেরে
বাধ্য হয়েই এই পূর্ব পুরুষের পেশাকে আগলে রেখেছি।
চুন শিল্পো কারিগর আজিজ মিয়া বলেন, আমরা যারা চুন তৈরি করি আমাদের আঞ্চলিক ভাষায় একে জুগি বলা হয়। আর এই চুন তৈরি করতে শামুক ও ঝিনুক সংগ্রহ করি প্রথমেই। আর তা সংগ্রহ করা হয়ে থাকে গ্রামের পাশে তিস্তার শাখা নদী থেকে। তবে এখন আর নদী থেকে শামুক সংগ্রহ করি না । এখন শামুক ক্রয় করে আনতে হয় । আর এই শামুক কিনতে হয় পাশের উপজেলা বৈরেতী হাঁটে। তারপর শামুক-ঝিনুক গুলো মাটির তৈরি খড়ির চুলায় পুড়িয়ে বড় একটি পাত্রে উঠিয়ে
পরিমান মতো পানি দিয়ে তা ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা ফুটানো হয়। ফোটানোর পর তা ছেকনি দিয়ে একটি গাছের গোরা চাড়ীর মতো তৈরি করে মাঠিতে বসিয়ে রাখেন সেখানে শামুক ও ঝিনুক গুলোকে একটি বেম্বু দিয়ে চূর্ণ বিচূর্ণ করে তৈরি করা হয় ধবধবে সাদা চুন। তবে চুন তৈরি করে রাজারে বিক্রয় করে এখন সংসার চলা খুবেই কষ্ট হয়ে পড়েছে । বাজারে সব জিনিসের দাম বাড়লেও এখনো চুনের দাম বাড়েনি। এখনো প্রতি কেজি চুন বিক্রয় হয় ২০-২৫ টাকা করে। জমিজমা তেমন কিছু
না থাকায় অন্য কিছু করবো তারও কোন উপায় নাই তাই কষ্ট হলেও করতে হচ্ছে বাপ দাদার এই ব্যবসা।
চুন উৎপাদনকারী নাজমুল জুগি বলেন, একবস্তা শামুক-ঝিনুকের দাম ১ হাজার থেকে ১২শ টাকা। তা থেকে প্রায় ৫০ কেজি চুন উৎপাদন হয়। এক কেজি চুনের দাম ২০ থেকে ২৫ টাকা। ৫০ কেজি চুন বিক্রি করতে সময় লাগে তিন-চার দিন। খরচ বাদ দিলে লাভের পরিমাণ খুবই কম। চুন শিল্পের সঙ্গে জড়িত ব্যাক্তিদের তেমন কোন কদর নেই। এই শিল্পো টিকিয়ে রাখতে সরকারি সহায়তা না পাওয়ায় মার খাচ্ছেন তাঁরা। চুনশিল্প রক্ষায় সরকারি ও বেসরকারি সহায়তা বাড়ানোর কথা বলছেন এ পেশায়
জড়িত ব্যক্তিরা।
উপজেলার বেলকা (ইউপি) চেয়ারম্যান ইব্রাহিম খলিলুল্লাহ বলেন, চুনশিল্প এই উপজেলার গৌরব। কিন্তু আয় কমে যাচ্ছে বলে অনেকেই পেশা ছাড়ছেন। ফলে শিল্পটি এখন বিলুপ্ত হতে বসেছে। এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখার জন্য আমরা স্থানীয়ভাবে আর্থিক সুবিধা দেওয়ার চেষ্টা করছি। উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা মো.জাফর আহমেদ লস্কর বলেন, এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য সহায়তা চাইলে তাদের ঋণ দেওয়া হবে।
comment / reply_from
related_post
Popular Posts
newsletter
newsletter_description