
অরক্ষিত নবাবগঞ্জের ঐতিহাসিক সীতারকোট বিহার নজরদারির অভাবে দখল হয়ে যাচ্ছে জমি
অলিউর রহমান মেরাজ নবাবগঞ্জ দিনাজপুর প্রতিনিধি :
দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ উপজেলার ঐতিহাসিক সীতাকোট বৌদ্ধবিহার অনেকটাই অরক্ষিত। নজরদারির অভাবে দখল হয়ে যাচ্ছে প্রায় দেড় হাজার বছরের প্রাচীন এ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের জমি। চুরি হয়ে যাচ্ছে ইটসহ মূল্যবান প্রত্নসম্পদ।
সীতাকোট ঘিরে রামের স্ত্রী সীতাকে নিয়ে কল্পকাহিনি থাকলেও এটি মূলত প্রাচীন বৌদ্ধবিহার। সনাতন ধর্মাবলম্বী অনেকের বিশ্বাস, সীতাকে পঞ্চবটির বনের গভীরে বনবাস দিয়ে তার থাকার জন্য কুটির হিসেবে এটি তৈরি করে দেওয়া হয়েছিল। তাই এটি সীতা কোট নামে পরিচিত।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অতিরিক্ত সচিব চন্দ কুমার দে জানান, ১৯৬৮ ও ১৯৭২ সালে দুদফা আংশিক খননের পর দেখা গেছে, এটি ছিল প্রাচীন বৌদ্ধবিহার। সীতার সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক ছিল না। সম্রাট অশোকের রাজত্বকালে তার রাজ্যে ৮৪ হাজার স্তূপ স্তম্ভ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। ওই সময় থেকে শুরু করে ষষ্ঠ শতাব্দী পর্যন্ত উত্তরবঙ্গে বৌদ্ধধর্মের বহু স্থাপনা গড়ে তোলা হয়। যার একটি এ সীতাকোট বৌদ্ধবিহার। নবাবগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে পশ্চিম দিকে বিরামপুরগামী রাস্তার উত্তর পাশে গোলাপগঞ্জ ইউনিয়নের ফতেপুর মাড়াস মৌজার প্রায় এক একর জমিতে স্থাপিত এ বৌদ্ধবিহার।
নবাবগঞ্জের ইউএনও এম এম আশিক রেজা বলেন, লম্বা-মধ্যম ধরনের গাঁথুনি, ছোট ইট এবং চুন সুরকির নির্মাণশৈলী দেখে গবেষকরা অনুমান করেন, এ বিহার পঞ্চম শতাব্দী বা এর কিছু আগে নির্মিত। বিহার খননের পরে বা আগে পাওয়া নিদর্শনের মধ্যে আছে নানা ধরনের হীরার ধারালো অস্ত্র (বাইশ), মাটির পাত্রের ভাঙা অংশ, মাটির দোয়াত, লোহার পেরেক, নকশা করা মাটির তৈরি মাছ, মাটির পুতুল, নকশা করা ইট, লোকেশ্বর পাদ্যুপানি এবং মজুশ্রী রোজ নির্মিত দুটি মূর্তিসহ লোহার রিং ও রড।
স্থানীয়রা জানান, বর্তমানে বিহারের পশ্চিম পাশে মাদ্রাসা গড়ে তোলা হয়েছে। বিহারের পূর্ব দিকের বিশাল দীঘিটি শালদীঘি নামে পরিচিত। সেখানে আশ্রয়কেন্দ্র গড়ে দীঘিটি একজন সরকারি কর্মচারীর আওতায় লিজ দেওয়া হয়েছে। পশ্চিম দিকে পুকুর ছিল, এখন তা নেই। উত্তর দিকে জঙ্গলের ওপারে ছোট নিচু জমিটি সম্ভবত পুকুর বা জলাশয় ছিল। বিহারের ভেতরে দক্ষিণ-পূর্ব দিকের কূপটিও ভরাট হয়ে গেছে।
দিনাজপুর-৬ আসনের সংসদ সদস্য শিবলী সাদিক বলেন, ঐতিহাসিক বিহারটি খুঁজে পাওয়ার কাহিনিও বেশ মজার। উত্তর দিকে মাড়াস গ্রামের মহিরউদ্দিনের ছেলে তালেব আলী বিহারের পাশের জমি চাষ করতে গিয়ে একটি জরাজীর্ণ অস্ত্র (বাইশ) পান। বাড়িতে নিয়ে ধার দিয়ে তা গৃহস্থালির কাজে লাগান তিনি। এ ধারালো অস্ত্র দিয়ে ২-১ কোপে বনের বড় বড় শালগাছ কাটা যেত। বন বিভাগের চোখ ফাঁকি দিয়ে এ কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন তালেব। একদিন ধরা পড়ার পর তাকে জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে বন বিভাগের কর্মকর্তাকে ওই ধারালো অস্ত্রটি দেখান। বন বিভাগ অস্ত্রটি নিয়ে পরীক্ষার জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠায়। পরে জানা যায়, অস্ত্রটি ছিল হীরার তৈরি। বিষয়টি জানাজানি হলে আরও মূল্যবান প্রত্নবস্তু মেলার সম্ভাবনা রয়েছে। এরপর জেলা পরিষদ নিজস্ব অর্থায়নে বিহার এলাকা খনন শুরু করে। তালেব আলীকে বিহার পাহারার চাকরি দেওয়া হয়। কয়েক বছর আগে মারা যান তিনি।
স্থানীয়রা জানান, এখনো বিহারের ইট চুরি হচ্ছে। বিহারের জায়গা অনেকে জবরদখল করে রেখেছেন। বিহারের ইমারতের জায়গা ছাড়া কিছু জায়গা চাষাবাদের জন্য পত্তন দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কেউ কেউ সেগুলোতে বসতবাড়ি গড়ে নিজের জমি বলে দাবি করছেন। বিহারের দুপাশে দুটি সাইনবোর্ড ছিল, সেগুলোও চুরি হয়ে গেছে। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ পরে আরেকটি সাইনবোর্ড স্থাপন করলেও সেটি এখন অস্পষ্ট।
প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের বগুড়া অঞ্চলের উপপরিচালক নাহিদ সুলতানা জানান, সীতাকোট বিহার সুরক্ষায় স্বল্পপরিসরে কাজ হাতে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু করোনার জন্য গত অর্থবছরে বৌদ্ধবিহারের কাজ শুরু করা যায়নি। চলতি অর্থবছরে বেষ্টনী প্রাচীর নির্মাণসহ অন্যান্য কাজ শুরু করা হবে।
comment / reply_from
related_post
Popular Posts
newsletter
newsletter_description